সাম্প্রতিক সময়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম ডেঙ্গু ভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটছে শত শত মানুষ। হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না, এমন খবরও আসছে গণমাধ্যমে। বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে হাজারো রোগী। শঙ্কিত মানুষ সন্দেহের বশেও ছুটছে রক্ত পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সংকট দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু পরীক্ষার উপকরণের।
জনবল সংকটে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল-ক্লিনিক। সার্বিক পরিস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক-নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাত-দিন এক হয়ে গেছে। ঘুম হারাম করে চিকিৎসকরা সেবা দিয়ে চলছেন প্রতিটি মুহূর্তের জন্য। ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতির আগেই লন্ডনে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে খোঁজখবর রাখছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। এদিকে গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশে অবস্থান নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বৈঠকে দেশের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির মধ্যে মন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
এত বড় দুর্যোগকেও যেন গায়ে লাগাচ্ছেন না দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রধানতম ব্যক্তি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি। উল্টো দেশের মানুষকে এমন রোগ-দুর্যোগের ভেতরে রেখে ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে দেশ ছেড়ে উড়াল দিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। গত শনিবার তিনি দেশ ছাড়েন। যা নিয়ে সব মহলে দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রক্রিয়া। স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশে নেই—এমন খবরে রীতিমতো ধিক্কার উঠছে। সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়ছে সরকার। সরকারি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতারাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন এসব প্রশ্নে।
মালয়েশিয়া যাওয়ার দুই দিন আগে ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিশ মশার বিস্তারকে প্রথানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক ও মহানুভবতায় আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করে সমালোচনার মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। যেখানে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরাও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছেন, সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন কথায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন তাঁরাও।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘এমন বিপদের দিনে মন্ত্রী দেশে না থাকায় আমরাও খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছি। সবাই নানাভাবে কটূক্তি করছে।’ আবার মন্ত্রী দেশে থাকলে কাজে আরো গতি আসত বলেই সবাই মনে করেন। অনেকেই নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। ডেঙ্গুতে মৃত্যু বা আক্রান্তের তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির কোনো সুরাহা কেউ দিতে পারছে না। ফলে এ নিয়ে মানুষের মনেও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল স্বাস্থ্যসচিবের একটি ব্রিফিংয়ের কথা ছিল মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেটি বাতিল করা হয়। যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মইদুল ইসলাম প্রধান কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন কাল (আজ মন্ত্রী নিজেই ওই ব্রিফিং করবেন)।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জানান, সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে যেভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তা ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন তাঁদের নানাভাবে নির্দেশনা দিয়েও কুলানো যাচ্ছে না। আবার উপকরণ ও জনবল সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে রোগীদের অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে। এমন পরিস্থিতি অস্থায়ী বা সাময়িক জনবল বাড়ানো কিংবা জরুরি ভিত্তিতে উপকরণ সংগ্রহ করতে হলে মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া গতি নেই।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে নানা রকম অস্থিরতার পেছনেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ভূমিকা রয়েছে। এমনকি বর্তমান তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থাকার সময়ে দুজনের মধ্যে বিরোধের বিষয়টিও প্রকাশেই আলোচিত হয়। এ ছাড়া তিনি প্রতিমন্ত্রী থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দায়িত্ব নিয়েই কয়েক দিনের মধ্যে নিজ দপ্তরের বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যত্র সরিয়ে দেন। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে। এ ছাড়া বিগত সময়ে স্বাস্থ্য খাতের বহুল আলোচিত গডফাদার ঠিকাদার বলে পরিচিত ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে ব্যাপক অনিয়মে অভিযুক্ত মোতাজ্জের হোসেন মিঠুকে আবার স্বাস্থ্য খাতে পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠেছে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে। মিঠুর সঙ্গে মন্ত্রীর সখ্যতায় সাধারণ ঠিকাদারদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।
এদিকে মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাহিদ মালেক এমপি এরই মধ্যে আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব, ভারত সফর করেছেন সরকারি খরচে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। আর এবার গেলেন ব্যক্তিগত কাজে মালয়েশিয়ায়।
গতকাল বুধবার বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এসব বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফোনে এই প্রতিবেদক কল করলে ওভারসিস রিং হয়, তবে মন্ত্রী কল রিসিভ করেননি বা পরে পাল্টা কলও করেননি, ফলে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে মন্ত্রীর এপিএস ড. আরিফুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রী মহোদয় রাতেই (গত রাত) ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন এবং কাল (আজ) সকাল ১০টায় মিটফোর্ড হাসপাতালে যাবেন ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেখতে। এ ছাড়া দুপুর ২টায় প্রেস ব্রিফিং করবেন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে।
ড. আরিফ এ সময় নিজের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘মন্ত্রী দেশের বাইরে থাকলেও সার্বক্ষণিক মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে কানেকটেড ছিলেন। সব খোঁজখবর রেখেছেন, দাপ্তরিক কাজও করেছেন। ফলে তিনি সশরীরে দেশে না থাকলেও তাঁর দায়িত্বের জায়গায় কোনো ঘাটতি হয়নি। এ ছাড়া চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। সেখানে কোনো ঘাটতি থাকলে তার দায় মন্ত্রীর ওপর বর্তায় না, সেটা অধিদপ্তরের দায়িত্ব।’ এপিএস আরো বলেন, মন্ত্রীর নিজেরও তো কিছু জরুরি ব্যক্তিগত প্রয়োজন থাকতে পারে। যে কারণে এক ধরনের নিরূপায় হয়েই তাঁকে যেতে হয়েছিল।
সংসদীয় কমিটিতে ক্ষোভ
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশে অবস্থান নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বৈঠকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি আলী আশরাফ। বৈঠকে কমিটির সদস্য মো. দবিরুল ইসলাম, মো. মুজিবুল হক, মইন উদ্দীন খান বাদল, আব্দুল মান্নান, মো. ফখরুল ইমাম, ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কমিটি সূত্র জানায়, বৈঠকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় কমিটির সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা ডেঙ্গু মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবহেলার অভিযোগও উত্থাপন করেন। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।
বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য মো. ফখরুল ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিটির দুজন সদস্য বলেছেন, এই মুহূর্তে মন্ত্রী বিদেশে থাকলে কিভাবে হবে? তবে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে চুপ ছিল। অবশ্য ডেঙ্গু নিয়ে তারা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। তবে তাতে কমিটি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
কমিটি সূত্র জানায়, বৈঠকে কমিটির সভাপতি আলী আশরাফ ও বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল সারা দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তাঁরা জানতে চান, এ সময়ে মন্ত্রী কেন বিদেশ সফরে গেলেন? এ ব্যাপারে কোনো জবাব না দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।
Facebook Comments