দুর্নীতি দমন কমিশনের-দুদক আইনি জালে আটকা পড়েছেন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রভাবশালী শতাধিক কর্তাব্যক্তি। ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ, ঘুষ, অর্থপাচারসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুদক। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দুদকের জালে আটকে পড়া প্রভাবশালীদের মধ্যে একদা দেশের প্রধান বিচারপতির মতো পদে দায়িত্ব পালন করা সাংবিধানিক পদধারীও রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি থেকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি আছেন আমলাও। এ তালিকার কেউ কেউ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কেউ বা কোনো আর্থিক বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। কেউ আবার সাবেক কূটনীতিক। প্রকৌশলী, মাদক ব্যবসায়ীর পাশাপাশি রয়েছেন রাজনীতিবিদ। এমনকি খোদ দুদকের পদস্থ কর্মকর্তাও রেহাই পাননি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, দুদকের জালে চুনোপুটি বেশি আটকে পড়লেও রুই-কাতলা বা বোয়ালও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি এবং চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। ১০ জুলাইয়ের এ মামলায় গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের মধ্যে রয়েছেন অধুনা লুপ্ত ফারমার্স ব্যাংক, বর্তমান পদ্মা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীম, সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্র্রেসিডেন্ট ও ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায় প্রমুখ।
একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো এ মামলা করার আগে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়েছে কমিশন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ও তার স্ত্রী হাসিনা আবেদীনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কমিশন। ২১ জুলাইয়ের এ মামলায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুদক। এ মামলায় ৮ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পুলিশের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের এক মামলায় সহযোগী হিসেবে স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য দুই সদস্যও আসামি। মিজান ইস্যুতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দুদকের কাছ থেকে রেহাই পাননি সংস্থাটির পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরও। পরস্পরের মধ্যে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় অনুসন্ধান শেষে অন্য এক মামলায় আসামি করা হয়েছে দুজনকেই। দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিতে ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে দুদকের বাছির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন বলে কমিশনের দাবি। অভিযোগ ওঠার পর, মামলায় আটকের আগে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন দুজনেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীসহ দুজনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক মাঠে নেমেছে। একটি আবাসিক হল ও অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প ও শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগে ইফতেখার আমলের কিছু তথ্য চেয়ে গত এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, প্রায় ৪৫ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি ও আত্মসাতের মামলায় বিটিসিএলের সাবেক দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. আবু সাইদ খান এবং এস এম খাবিরুজ্জামানসহ নয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) কাছ থেকে ৫৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। সূত্র জানিয়েছে, বিআইএফসির পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণের ঋণ অনিয়মের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানের সম্পৃক্ততা পেয়ে ব্যবস্থা নিতে ২০১৫ সালে দুদক ও সিআইডিকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি দুই মামলায় রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান কে এ এম হারুন ও হুমায়ূন খাদেম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান ও বিসিএসআইআরের সদস্য (অর্থ) মুহাম্মদ শওকত আলীকে আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব আ ই ম গোলাম কিবরিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুল্লাহ আল বাকিসহ মোট ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেনসহ সাবেক দুই পরিচালকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। সপরিবারে দেশত্যাগের আঁচ পেয়ে তাদের বিদেশযাত্রায় ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুদক। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাবেক কাউন্সিলর মো. মাকসুদ খানের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। কানাডায় পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকার সময় অর্থ লোপাটের ঘটনায় ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর মামলা করে দুদক। দুদক সূত্র মতে, পৌনে ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক সচিব এ টি এম সারওয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী নাজমা সারওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। ৭ জুলাইয়ের এ মামলায় পরস্পর যোগসাজশে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে পাঁচ কোটি ৮৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, দখলে রাখা ও স্থানান্তরের দাবি করা হয়েছে। বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল স্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান তালুকদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে। ৩০ মে ১১০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে করা মামলায় আবদুল মান্নান গ্রেফতার হলেও আনিসুর রহমান পলাতক। কয়লা লোপাটের মামলায় বড় পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সাবেক সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। আসামিদের বিরুদ্ধে ২৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা দামের এক লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অবসরপ্রাপ্ত কাস্টমস কমিশনার, কবি ও গীতিকার এ এইচ এম শাহাবুদ্দীন নাগরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পাঁচ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সালাম ও তার স্ত্রী রেশমা মজুমদারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে দুদক। ১৪ জুলাই মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এবি ব্যাংকের গ্যারান্টিতে সিটিসেলের নামে ৩৮৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলায় দুদক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, তার স্ত্রীসহ ১৬ জনকে আসামি করেছে। ওই ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিটিসেলের সাবেক কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এ মামলার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট ১১ জনের বিদেশ যাত্রায় সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে এক হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে দুদকের সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের করা এ মামলায় মালিকদের মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরসহ সাতজন এবং ব্যাংকারদের মধ্যে ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদসহ ২৫ জন দুদকের মামলার আসামি। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের মামলার তদন্ত চলছে।
Facebook Comments