মো: গোলাম মোস্তফা (মাস্তাক) বিশেষ প্রতিনিধি, পাবনা। ১৯৭১সালের সালের৭মার্চ। বীরদর্পে মঞ্চে উঠলেন স্বাধিনতার মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ততোক্ষনে তখনকার রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ন। শুরু করলেন সেই মহাক্যাবিক ভাষন। বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত হলো স্বাধিনতা সংগ্রামের সেই অমর বানী -এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধিনতার সংগ্রাম। লাখো জনতার মূহমূহ শ্রোগান আর করতালির মাধ্যমে প্রকম্পিত হলো রেসকোর্স ময়দান। সেদিনের সেই ১৮ মিনিটের বক্তৃতা বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার প্রেরনা যোগায়। ১৮ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই ভাষনের 50 বছর পূর্তি হচ্ছে । ১৯১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো (UNESCO) এই ভাষণটিকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফলে ভাষনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি বা মর্যাদা লাভ করেছে। সেই ঐতিহাসিক ভাষনের ক্ষেত্র হয়েছিল ১৯৭0 সালের৭ ডিসেম্বরের পাকিস্থানের সাধারন পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে । নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতে জয়লাভ করে। নিরুঙ্কুষ সংখ্যাগষ্ঠিতা লাভের পরও পাকিস্থানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে । পহেলা মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ফুঁসে উঠে বাঙালী । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় হরতাল, অবরোধ আর অসহযোগ আন্দোলন। সারা পুর্ব পাকিস্থান জুড়ে গর্জে উঠে বীর বাঙালী । স্বত:স্ফুর্ত আন্দোলন দমনে সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করে নিরীহ আন্দোলনকারীদের। ১৯৭১ সালের ২মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় আয়োজিত এক ছাত্র সমাবেশে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। দেশ ব্যাপি কৃষক, শ্রমিক ছা্ত্র, শিক্ষক জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধের সাথে সাথে স্বাধিনতা যুদ্ধের প্রস্ত্তুত চলতে থাকে । আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের মহাসমাবেশের প্রসত্তুতি চলতে থাকে। পূর্ব পাকিস্থান বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ দলে দলে সমবেত হতে থাকে সেদিনের সেই রেসকোর্স ময়দানে দুপুর না গড়াতেই কানায় কানায় পরিপূর্ন হয়ে উঠে রেসকোর্স ময়দান। ৭ মার্চের ১৮ মিনিটের বক্তব্যের ঠিক ১৮ দিন পরেই জন্ম হল একটি নতুন ইতিহাস। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। শুরু হয় গণহত্যা, ধর্ষণ। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। তার গ্রেফতারের পূর্বেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা করলেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লক্ষ শহীদের আর দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্জিত হলো সেই কাংখিত বিজয় । বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের যাদুকরী ক্ষমতা এবং সম্মোহনী শক্তি বাঙলী জাতীকে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর 7 মার্চের 18 মিনিটের ভাষনে শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্থানকে ভৌগলিকভাবে মুক্ত করার বিষয ছিল না বরঞ্চ তার মাধ্যে নিহিত ছিল বাঙালীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিরে আহবান। আজ 7 মার্চের 50 বছর পূর্তিতে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায় স্বাধিনতার 50 বছরের ইতিহাস স্বাভাবিক গতিতে চলেনি। স্বাধিনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৫জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর দেশ পূর্নগঠনের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার পরপরই শুরু হয দেশী ও আর্ন্তজাতিক মহলের দেশ বিরোধী চক্রান্ত। কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিবিদ ও উচ্চাভিলাষি বিপথগামী সেনাসদস্য ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৫ আগষ্টের পর দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের যাতাকলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা চলতে থাকে। মিডিয়া, পাঠ্য পুস্তক এমনকি সংবিধানে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ৭৫’ পরবর্তী দীর্ঘসময় ৭মার্চের ভাষন প্রচার করার মত মুক্ত এবং উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযদ্ধের ভুল ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।৭৫ ’ এর পট পরিবর্তনের দীর্ঘকাল পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসায় পরিবেশ পরিস্থিতির বদলাতে থাকে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং প্রকৃত ইতিহাস সাধারন মানুষ ও নতুন প্রজন্মের কাছে পোঁচ্ছে দেয়ার জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। কিন্ত্তু দীর্ঘদিনের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রচার প্রচারনা এবং ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক অংগনে এখনও অন্ধকার ছড়াচ্ছে। এ সমস্ত অগাছা শেকড়সহ উপড়ে ফেলতে না পাড়লে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন বিফলে যাবে। বর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ ঈর্ষনীয় ভাবে অর্থনেতিক অগ্রগতির দিকে এগোচ্ছে কিন্ত্তু কিছু নব্য অতি আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে । চাঁদাবাজি , অর্থ পাচার এবং ভীন্নমতের প্রতি অসহিঞ্চতা সরকারের সকল অর্জনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। গত কয়েক দিনে আগে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত করার সুপারিশ করেছে।২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পোঁচ্ছে যাবে। কিন্তু ব্যাপক ঘুষ, দুর্নীতি, আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের যাঁতাকল থেকে গণমানুষকে মুক্ত না পারলে সেই উন্নয়নের পথ দূরুহ হবে । তাই আজ ৭ মার্চের পঁঞ্চাশ বছর পূর্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু কন্যাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মুক্তি সংগ্রামে।
Facebook Comments